একটি অপ্রেমের গল্প
সেদিন বিকেলটা হঠাৎ
করেই বেশ খানিকটা আগে চলে এসেছিলো।সকাল থেকে গুমোট করেই ছিল আর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ঝমঝমিয়ে
বৃষ্টি শুরু হলো। শহরের গুমোট ভাবটা কেটে গেল ঠিকই কিন্তু ততক্ষনে আমার ভেতরে রক্তক্ষরণ
শুরু হয়ে গেছে। মিতা, হ্যাঁ মিতা আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা। আজকে মুম্বাই শহরের নরিম্যান
পয়েন্টে আমার সতেরোতলার কেবিনে বসে একটা ব্ল্যাক কফি খেতে খেতে এইসব পুরোনো কথাগুলো
মনে পড়ছিলো।
ও হ্যাঁ, আমি আর্য।
মফঃস্বলের ছেলে আমি। কলকাতা শহরের থেকে বেশ দূরে, গঙ্গার ওপারে ব্যান্ডেল শহরে আমার
ছোটবেলাটা কেটেছে। পড়াশোনায় যে খুব ভালো ছিলাম তা নয়, কিন্তু মাস্টারমশাইয়ের মার্ ও খুব একটা খাইনি আমি। ওই আপনারা টাকা পয়সার
হিসেবে যাকে উচ্চ মধ্যবিত্ত বলেন, সেরকমই পড়াশুনায় আমি ছিলাম উচ্চ মধ্যবিত্ত গোত্রের।
যাই হোক, আজকে সকাল
থেকে পুরোনো কথাগুলো বারবার মনে পড়ছে তার কারণও ওই মিতা। পুরো নাম মিতা মজুমদার। ব্যান্ডেল
এর একটি নামি ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে পড়তো। তখন ১৯৯৬ সাল। এই সদ্য মাধ্যমিক পাশ করে বেরিয়ে
একটা মোটামুটি ভালো সরকারী স্কুলে সায়েন্স নিয়ে
ভর্তি হয়েছি। তখন তো আর মোবাইল বা স্মার্ট ফোন ছিল না আমাদের কাছে, তাই বিকেলবেলাটা
পাড়ার রাস্তায় ক্রিকেট বা ফুটবল খেলেই কেটে যেত।
মিতা আমাদের পাশের
পাড়াতেই থাকতো আর ওকে স্কুলে যেতে হতো আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই। উঠতি বয়সে হঠাৎ করে
হাঁটুর কাছাকাছি স্কার্ট পড়া মেয়ে দেখলে বুকের ভেতর বেশ ধুকপুকুনি শুরু হয়ে যেত। স্বীকার
করতে লজ্জা নেই, সেইবয়সে ওকে নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম যাতে ভালোবাসার
থেকেও বেশি ছিল একটা নিষিদ্ধ আকর্ষণ। মনের ভেতরে একটা তীব্র ইচ্ছা হতে লাগলো মিতাকে
কাছে পাওয়ার।
শুরু করলাম খোঁজ খবর
নেওয়া, মিতা কোথায় কোথায় টিউশনি পড়তে যায় আর কখন যায়, বের করে ফেললাম এক সপ্তাহের মধ্যেই।
মিতাও সায়েন্স নিয়ে পড়াতে আমার বেশ সুবিধাই হয়েছিল। এরপর বাবাকে রাজী করিয়ে ভর্তি হয়ে
গেলাম মানব স্যারের কেমিস্ট্রি কোচিং এ। তারপর যা হয় আর কী, আলাপ পরিচয়ের পালা সাঙ্গ
করে, ওকে জানালাম যে আমি তার পাশের পাড়াতেই থাকি। ব্যাস, শুরু হলো আমাদের একসাথে কোচিং
গমন এবং আগমন। পড়াশোনায় মোটামুটি ভালো থাকায়, পড়াও বুঝিয়ে দিতে শুরু করলাম। এইভাবে
মাস তিনেক বেশ ভালোই কাটলো। মিতা বেশ সহজ সরল মেয়ে ছিল, তাই খুব সহজেই আমরা বন্ধু হয়ে
যেতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমার মনে তো অন্য ধান্দা, যে করেই হোক মিতাকে আমার চাই। কিন্তু
এতো বছর পরে মনে হয়, খুব ভুল করেছিলাম ওর সাথে আর নিজের সাথেও। তাই কুড়ি বছর পরেও আমার
ভেতরে একটা শূন্যস্থান রয়েই গেছে।
এরকমই একদিন মানব
স্যারের কোচিং থেকে বেরিয়েছি আমি আর মিতা। এখনো মনে আছে, মিতা সেদিন পড়েছিল একটা সবুজ
চুড়িদার। সেদিন সকাল থেকেই বেশ গুমোট লাগছিলো। গরমের বিকেলে এটা কালবৈশাখীর আভাস। উত্তরপাড়ার
গলিটা দিয়ে বাড়ী ফিরছি দুজনে হেঁটে। হঠাৎ আমি আচমকা মিতার গালে একটা চুমু খেয়ে ফেলি,
অবশ্যই ইচ্ছে করে। আমি দেখতে চাইছিলাম ও কিভাবে এটার উত্তর দেয়। আমার এরকম আচমকা চুমুতে
মিতা এক মুহূর্তের জন্য একটু হতভম্ব হয়ে পড়ে, তারপরেই সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সজোরে একটা
চড় কসায় আমার গালে। মিতার দুচোখ দিয়ে আগুন ঝরছিল সেদিন, বিশ্বাসভঙ্গের আগুন। তিন মাসে
আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছিলাম, মিতা ভাবতেই পারিনি আমি এমন কিছু করতে পারি। আমাকে
ভালো বন্ধু হিসেবেই ভেবেছিলো ও, কিন্তু আমার মধ্যে যে একটা অন্য মতলব কাজ করছে, সেটা
ও জানতো না। আমিই জানতে দেইনি কখনো। ভেবেছিলাম একটা চুমু খেয়ে দেখি, যদি ও রেগে যায়,
তাহলে সরি বলে মানিয়ে নেবো আর এ যদি আমাকে পছন্দ করে, তাহলে আমাদের মধ্যে ব্যাপারটা
অনেক সহজ হয়ে যাবে। কাঁচা মাথার বুদ্ধি আর কি! কিন্তু এরকম একটা থাপ্পড় খাবো সেটা ভাবতেই
পারিনি।
থাপ্পড় মারার পরে
মিতা একটাও কথা না বলে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেছিলো আর আমি আমার মনের ভেতরে মিতার আগুনঝরা
চোখদুটো দেখতে পাচ্ছিলাম। এভাবে কতক্ষন গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না, হঠাৎ
বৃষ্টি এসে যাওয়াতে আমার ভেতর থেকে বুক ঠেলে একদলা কান্না উঠে এসেছিলো সেদিন। সেদিনই
বুঝতে পেরেছিলাম কতোবড় ভুল করে ফেলেছি। আমার আর সাহস ছিলোনা মিতার মুখোমুখি দাঁড়ানোর।
সমাপতন কিনা জানি
না, সেদিন রাতে বাবা অনেক খাবারদাবার নিয়ে বাড়ি ফিরলো। বুঝলাম, বাবার একটা ভালো প্রোমোশন
হয়েছে আর আমিও বাবার সাথে বদলি হয়ে যাচ্ছি খড়্গপুরে। এক সপ্তাহের মধ্যেই আমরা চলে আসলাম
খড়্গপুরের ব্যাঙ্ক অফিসার্স কোয়ার্টারে। শুনলাম বাবাকে রিজিওনাল ম্যানেজার পোস্টে প্রোমোশন
দেয়া হয়েছে। খড়্গপুর এ আমরা তিন কামরার একটা বাড়ী পেলাম, সামনে বাগান, বেশ ছিমছাম।
গত এক সপ্তাহে আমি আর মিতার সাথে দেখা করতে যেতে পারিনি। মন চেয়েছিলো, কিন্তু সাহস
করে উঠতে পারিনি। বলা ভালো ব্যান্ডেল থেকে একপ্রকার পালিয়ে বেঁচেছিলাম আমি।
নতুন জায়গায় এসে নতুন
স্কুলে ভর্তি হলাম, নতুন বন্ধু হলো। কিন্তু মিতাকে কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না। ভালো
করেই বুঝতে পারছিলাম, যে মিতার প্রতি আকর্ষণ তা শুধুমাত্র শরীরী ছিল না, মন থেকেই চাইতাম
ওকে। কিন্তু বয়ঃসন্ধির অমোঘ আকর্ষণে নিজেই কখনো বুঝতে পারিনি। প্রথম ৩-৪ মাস শুধু ওর
কথাই ভেবে গেছি খড়্গপুরে এসে। বুঝলাম, মানুষের সব ইচ্ছাপূরণ হয় না। মিতার জন্য নিজের
ঘরে বসে চিঠি লিখতাম, কিন্তু কখনো পোস্ট করতে পারিনি। তখনকার দিনে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক
থাকলে হয়তো ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারতাম, কিন্তু যোগাযোগটা আর হয়ে ওঠেনি।
ব্যান্ডেলে আমার বনধুদের
সাথে যোগাযোগ ছিলই। ওদের থেকেই পরে শুনতে পেয়েছিলাম, মিতাও নাকি দিল্লী চলে যায় উচ্চ
মাধ্যমিক এর পর। এরপর কেটে গেছে প্রায় কুড়িটা বছর। মিতার স্মৃতি এখন অনেক ফিকে, মনেও
পড়েনা সচরাচর। কিন্তু ওর সেদিনের সেই আগুনঝরা চোখদুটো আমি ভুলতে পারিনি কোনোদিন। ওই
একটা থাপ্পড় আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছিলো সেদিন। এরপরে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অনেক মেয়ে
বন্ধু আমার হয়েছে কিন্তু কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখিনি আর। মিতার ঘটনাটা আমার মনে খুব গভীর
একটা প্রভাব ফেলেছিলো। পড়াশুনাতেও বেশ পিছিয়ে গেছিলাম কয়েক মাসের জন্য, তবে সেটা আবার
ঠিক করে নিতে পেরেছিলাম।
কলেজ থেকে পাশ করে
প্রথম চাকরি পাই মুম্বাই শহরে। সেই যে ২০০৩ সালে মুম্বাই আসি, তখন থেকে এখানেই রয়ে
গেছি। স্বপ্ননগরী মুম্বাই আমাকে যেমন নিংড়ে নিয়েছে, সেরকম ভাবে অর্থ, যশ আর বিত্ত উজাড়
করে দেয়েছেও। আজকে আমি এখানকারই স্থায়ী বাসিন্দা আর দেশের অন্যতম নামকরা ইঞ্জিনিয়ারিং
কন্সালটেন্সি কোম্পানির মালিক। আজকে দেশের তিন প্রান্তে আমার অফিস আছে আর প্রায় তিনশো
লোক আমার কোম্পানিতে কাজ করে। ভারতবর্ষ ছাড়াও আমরা দুবাই, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম এ অনেক
কাজ করেছি। বাবার রিটায়ারমেন্ট এর পর বাবা, মা কে মুম্বাই নিয়ে চলে আসি। বাবা আমার
কোম্পানির অন্যতম ডিরেক্টর এবং সি এফ ও হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন।
ছত্রিশ বছর বয়স হলো, মা এবারে আমার বিয়ে নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছেন।
যেখানে সাধারণত ৩০
বছরের মধ্যেই বাঙালী ছেলেদের মোটামুটি বিয়ে হয়ে যায়, সেখানে আমার ছত্রিশ বছরেও বিয়ে
হয়নি এখনো, বা বলা ভালো করা হয়ে ওঠেনি। ব্যাবসার শুরু থেকে আজকের জায়গায় আনতে গিয়ে
আমি নিজেকে সময় দিতে পারিনি একদম।সারাদিন শুধু কাজ করে গেছি ব্যাক্তিগত জীবনের দিকে
না তাকিয়ে। এক একটা দিন গেছে যখন টানা ১৮ ঘন্টা কাজ করেছি প্রোজেক্ট এর ডেডলাইন যাতে
মিস না হয়। আমার পরিশ্রমই আজকে আমাকে সাফল্যের এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে।
গতকাল সন্ধেবেলায়
অফিস থেকে বেরিয়ে মনে হলো একটু রিলাক্স করা দরকার। ড্রাইভার কে বললাম লীলা হোটেলে গাড়ি
নিয়ে যেতে। অনেকদিন পর একটু মদ খেতে ইচ্ছে করছে। লীলার পুলসাইডে এক পেগ স্কচ নিয়েই
মনে পড়লো কাল অফিসে ইন্টারভিউ আছে। আমাদের দুজন সিনিয়র ম্যানেজার দরকার কারণ হাতে কিছু
নতুন প্রোজেক্ট ঢুকেছে আর সিনিয়র লেভেলের ব্যাপারটা আমি নিজে দেখতে পছন্দ করি। শ'দেড়েক
আবেদনের ভেতর আমাদের অফিস ম্যানেজার ঝাড়াই বাছাই করে দশটা বায়োডেটা দিয়ে গেছে। সারাদিন
কাজের চাপে আর দেখা হয়ে ওঠেনি।ভাবলাম এই বেলা দেখে রাখি কারণ কাল এদেরকে ডাকা হয়েছে
মুখোমুখি ইন্টারভিউ এর জন্য। যারা আসছে তারা প্রত্যেকেই সিনিয়র লেভেলের লোক, কাজেই
এদের সম্বন্ধে একটু জেনে রাখা ভালো।তিন নম্বর বায়োডেটা টায় এসে একটা হোঁচট খেলাম। মিতা
মজুমদার, ব্যান্ডেলে স্কুলিং আর তারপর দিল্লী থেকে কলেজ পাস্ করে এখন মুম্বাইতে ইঞ্জিনিয়ারিং
কনসালটেন্ট হিসেবে কর্মরত।
হঠাৎ করেই পুরোনো
দিনগুলো আবার চোখের সামনে ভেসে উঠতে শুরু করলো। আমাদের কাটানো ভালো সময়গুলো থেকে শুরু
করে সেই চড় খাওয়ার ব্যাপারটা মনে পড়ে গেলো
আবার। আমার মনের ভেতর যে কি চলছিল তখন তা ভাষায় আমি বর্ণনা করতে পারবো না। জীবনের প্রথম
ভালোবাসাকে ভোলা প্রায় অসম্ভব, তারপর তার ঐভাবে চলে যাওয়াটাও আমার মন মেনে নিতে পারেনি।
আমি তো প্রায় ভুলেই ছিলাম, হঠাৎ করেই ভীষণ বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে পড়লাম আবার। বুঝে
উঠতে পারছিলাম না কাল কিভাবে ওকে ফেস করবো। নিজের মনকে প্রবোধ দিতে বললাম, "আর্য,
কুড়ি বছর কেটে গেছে, হয়তো ও ভুলেই গেছে তোমাকে। তোমার চেহারা বদলেছে, দাঁড়ি রেখেছো,
তোমাকে চেনা অতো সহজ হবেনা"।
রাতে বাড়ী ফিরলাম
খুব অস্বস্তি নিয়ে। ওর বায়োডেটাতে ফোন নম্বর থেকে ইমেইল আই ডি সবই লেখা ছিল, এমনকি
ওর মুম্বাই এর ঠিকানাও। কিন্তু নামের আগে লেখা ছিল "MS" যেটা বিবাহিত বা অবিবাহিত সবাই ব্যবহার
করতে পারে। আলাদা করে কোথাও লেখা ছিল না যে ও বিবাহিত কিনা। বুকের ভেতর একটা পাথর নিয়ে
প্রায় সারারাত জেগে রইলাম সকালের অপেক্ষায়।
পরদিন সকালে যখন অফিস
পৌছালাম তখন আমার চোখ লাল। আমি ইচ্ছে করেই দাঁড়ি কাটিনি যাতে আমাকে সহজে চেনা না যায়।
যদিও আমি খুব কম সিগারেট খাই, তবুও গাড়ীতে যেতে যেতে দুটো সিগারেট খেয়ে নিলাম। আমার
আত্মবিশ্বাস প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছিল। যার হাতে থাপ্পড় খেয়ে মেয়েদেরকে নতুন ভাবে
দেখা শুরু করেছিলাম সেই নাকি আজকে আমার অফিসে আসবে ইন্টারভিউ দিতে! অন্য কেউ হলে হয়তো
ভাবতো যে সে জিতে গেছে কারণ সে মিতার থেকে অনেকে বেশি সফল। কিন্তু আমি ভাবছিলাম কিভাবে
ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াবো! কি হবে যখন ও আমাকে চিনতে পারবে! একবারও জিতে যাবার কথাটা মাথায়
আসেনি। শুধু অপেক্ষা করছিলাম কখন ও আসবে আর কখন আমি ওকে সব সত্যি কথাগুলো বলতে পারবো।
দুই বছর পর:
৩০ শে জুলাই, আমার
জীবনের সবথেকে আনন্দের দিন। কিছুক্ষন আগেই আমার আর পরমার কোল আলো করে এসেছে আমাদের
প্রথম সন্তান। বাবা নাম রেখেছেন আর্যেশ। আর্য'র ছেলে আর্যেশ। ও হ্যা, পরমা আমার স্ত্রী।
আমার জীবনকে সম্পূর্ণ করেছে পরমা। ভাবছেন মিতার কি হলো আর কেনই হঠাৎ পরমা কে বিয়ে করলাম
!
সেদিন মিতা এসেছিলো
সাড়ে এগারোটা নাগাদ। আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমি নিজের কেবিনে মিতাকে ডেকে নি। প্রথমে চিনতে
পারেনি কারণ কুড়ি বছরে মানুষের চেহারা অনেক বদলে যায়। কিন্তু আমার কেবিনের সামনে আমার
নামটা পড়ে একটু চমকে যায়। আমি সেদিন মিতাকে সব সত্যি বলেছিলাম। বলেছিলাম আমার উদ্দেশ্য
কি ছিল আর কেনই বা ওর সাথে বন্ধুত্ব করেছিলাম। একদমে বলে গেছিলাম সব। মিতা মন দিয়ে শুনেছিলো। আমার কথা
থামলে বলেছিলো যে কুড়ি বছর আগেকার ঘটনাটা সে
ভুলে গেছে এবং তার জন্য আমার প্রতি কোনো রাগ তার নেই। মিতা তার নিজের জীবনের একটা ঘটনা
শুনিয়েছিল যেটা তার জীবন প্রবাহকে একদম খাতে ঘুরিয়ে দিয়েছিলো।
মিতা দিল্লী চলে যাবার
পর কলেজে তার এক প্রেমিক জোটে। দিল্লীর ধনী ব্যাবসায়ী পরিবাবের সন্তান। দু বছরের সম্পর্কে
তারা দুজনে অনেকবার আগ্রা বা সিমলা বেড়াতে গেছিলো বাড়ীতে লুকিয়ে। দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস
চলাকালীন মিতা জানতে পারে যে সে অন্তঃসত্ত্বা। এই ব্যাপারটা তার সেই প্রেমিকটিকে জানাতেই
সে মিতার জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। মিতা এক বন্ধুর সাহায্যে দিল্লীর একটি অনুমোদনহীন
ক্লিনিক থেকে গর্ভপাত করায়। কিন্তু অপারেশনের পরে প্রবল শারীরিক সমস্যা শুরু হওয়াতে,
মিতাকে নিজের জরায়ু কেটে বাদ দিতে হয়|
মিতা আর কোনোদিন মা
হতে পারবে না। এই ঘটনার পর মিতা আর কাউকে বিশ্বাস
করতে পারেনি। শুধু নিজের কেরিয়ারের দিকে মনোযোগ দিয়েছিলো। প্রবল মানসিক ট্রমা
কাটিয়ে উঠেছিল শুধু নিজের চেষ্টায়। মিতা আমাকে সেদিন বলেছিলো যেন আমি তাকে নিয়ে কোনো
স্বপ্ন না দেখি কারণ সে একাই ভালো আছে এবং একাই থাকতে চায়। কুড়ি বছর আগেকার কোনো ঘটনার
জন্য আমি যেন নিজেকে দোষী না মনে করি। আমি মিতাকে চাকরিটা অফার করি কিন্তু মিতা রাজি
হয়নি। বলেছিলো তার যোগ্যতায় সে বিশ্বাস করে তাই অন্য কোথাও সে সিনিয়র ম্যানেজারের চাকরি
ঠিকই পেয়ে যাবে। আর আমাকে অনুরোধ করেছিল যাতে আমি ওর সাথে আর যোগাযোগ না করি।
আমি ওর ইচ্ছেকে সন্মান
জানিয়ে আর কখনোই ওর সাথে যোগাযোগ করিনি ওর ফোন নম্বর জানা সত্ত্বেও। কিন্তু মিতার ওই
থাপ্পড়টা আমি কখনোই ভুলতে চাইনা, কারণ ওই একটা ঘটনা আমাকে মানুষ হতে শিখিয়েছিলো, মহিলাদের
সন্মান করতে শিখিয়েছিলো। নাহলে আমার জীবনটাও অন্য খাতে বইতে পারত।
এখন আমার প্রধান কাজ
হলো আমার সন্তানকে ভালো মানুষ তৈরি করা। সেওতো একজন ধনী ব্যাবসায়ী পুত্র। কিন্তু সে
যাতে একজন সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে পারে সে ব্যাপারে আমাকেই সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
কারণ এরাই দেশের ভবিষ্যত।
লেখক - অভীক দাস
No comments: