Header Ads

আজকের ছোটো গল্প "চাঁদা" - লিখেছেন দীপারুণ ভট্টাচার্য্য

পূজো এসে পড়েছে। আমার কিশোর বয়সের পুজোগুলো কেটেছে কোলকাতার শহরতলীতে। জায়গাটার নাম হাতিয়ারা। পরিচিত জায়গা বাগুইআটি থেকে, তিন কিলোমিটার ভিতরে।

ছোটবেলা আমি চাঁদার জুলুম হয়তো দেখিনি তবে চাঁদা নিয়ে পাড়ার দাদাদের সাথে বাবা কাকাদের বচসা দেখেছি। পাড়ার দাদারা আসতো কাজের দিনে। যখন বাবা বাড়ী নেই। একটা মোটা টাকার বিল কেটে মা বা আমাকে দিয়ে পালিয়ে যেতো। পরে এসে বলতো, কাকু একশোর বিলে মাত্র একুশ? একান্ন অন্তত দিন।
বাবা বলতো, আরও অনেককে দিতে হবে, এর থেকে বেশী পারবো না।

দলের মধ্যে থেকে একজন মোটাসোটা দাদা এগিয়ে এলো; নাম নিতাই। লোকে তাকে মাংস নিতাই বলতো। হাতিয়ারা বাজারে তার মাংসের দোকান। সে একটা পুরনো বিল বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটা পাতা বার করে বলে, ওসব বললে তো চলবেনা কাকু! এই তো গত বার আপনি পচাত্তর টাকা দিয়েছিলেন। এবারে একুশে কেন মানবো?
বাবা বেশ রেগে গেছে তখন। হাত দেখিয়ে বলে, এক চড়ে কান ছিড়ে দেবো নিতাই। গত বার একুশই দিয়েছিলাম। আমার বিলে তোর সই করা আছে। বার করবো?

নিতাই দুপা পিছিয়ে যায়। এবার জগা এগিয়ে আসে। গলা তার খুব মিহি তখন, কাকু, আপনারা না দেখলে তো পূজো হবেই না। সব জিনিসেরই দাম বাড়ছে। একটু বাড়িয়ে দিন।

শেষমেষ একত্রিশ টাকাতে রফা হয়। বাবা বিলটা আমার হাতে দিয়ে বলেন, যা এটাকে তুলে রাখ।
তুলে রাখা মানে আঁকশিতে ফুটিয়ে রাখা ,তখনকার সময় সবার বাড়িতেই একটা না একটা আঁকশি থাকতো। নিচে একটা ক্যারাম এর গুটি আর তার সাথে লাগলো একটা লোহার শিক। মুখটা একটু বাঁকানো যাতে সেটা পেরেকে ঝুলিয়ে রাখা যায়।

তখন আমাদের পাড়াতেও একটা পূজো হতো। সেই পুজোর চাঁদা তুলতে আমিও কয়েকবার বেড়িয়েছি দাদাদের সাথে। তবে আমরা পাড়ার বাইরে চাঁদা চাইতাম না। ওটা পাড়ার পুজো। পরিবার পিছু একটা টাকা ধরাই থাকতো। তাই চাঁদা তুলতে তেমন বেগ পেতে হতো না। তার মধ্যেও একবার ফেঁসে গেলাম। তখন উচ্চ-মাধ্যমিকে পড়ি। পাড়ায় নতুন বাড়ী করে এলেন কর্মকার বাবু। সোনা গেলো তিনি নাকি রাইটার্স-এ কাজ করেন। স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। মেয়ে দুটি যমজ। আমাদের সাথেই পড়তো। তাই ওই বাড়ীতে চাঁদা চাইতে যাবার সময় দলে বেশী লোক পেলাম। আনুদা প্রস্তাব পেশ করলো, কাকু, এমনিতে তো পরিবার পিছু পাঁচশ এক টাকা ধরাই আছে। আপনি প্রথম এই পাড়াতে এসেছেন, আমরা চাইবো আপনি এবার হাজার এক টাকা দেবেন।

কর্মকার বাবু একটা সঙ্গত প্রশ্ন তুললেন, আমি কি করে জানবো যে তোমরা এই পাড়া থেকেই এসেছো?
শানুদা বলল, কেন, আমরা তো আপনাকে এই পাড়ারই বিল দিচ্ছি।
- দেখো ভাই, আমি তো আর বিল যাচাই করতে যাবোনা। তাছাড়া এতো গুলো টাকা তোমাদের হতেও আমি দিতে পারবোনা। তোমরা বরং বড়দের আসতে বলো।
- আমরাই তো সব বাড়ী থেকে চাঁদা তুলছি কাকু।
- সে তুলছো তোলো। আমি তোমাদের চাঁদা দেবোনা। আমিতো তোমাদের চিনিই না।
- আপনি নতুন এসেছেন, আপনার পক্ষে কি সবাইকে চেনা সম্ভব?
এমনি কথার মধ্যে ভানুদা এগিয়ে এলো। গলাটা মিহি করে বলল, আমরা কিন্তু আপনাকে ভালই চিনি কাকু। চোখ তখন তার ভেতরের দিকে। যদি জোড়া প্রতিমার দর্শন হয়ে যায়।

এবার কর্মকার বাবু গলা তুললেন, হ্যাঁ, আমাকে আর চিনবেনা আমার ঘরে দু-দুটো সুন্দরী মেয়ে রয়েছে; আমিতো বিখ্যাত হবোই।
গরুর পালে যেন বাঘ পড়লো। আমরা লেজ তুলে পালালাম।

বছর কয়েক বাদে, তখন পড়াশুনার সুবিধার জন্য আমি আমার পিসির বাড়ী শিয়ালদাতে থাকতাম। সেখানে অখিল মিস্ত্রী লেনে বেশ বড় পূজো হতো। একদিন দুপুরে পিসেমশাই আর আমি টিভি দেখছি হঠাৎ দেবাশীষদা এলেন। দেবাশীষদা অখিল মিস্ত্রী লেনের চাঁদা তোলা কমিটির হেড তখন। এসেই বেশ রোয়াব নিয়ে বলল, চল দীপু পূজোর চাঁদা তুলতে যাই।
আমি সম্পূর্ন অরাজী। বললাম, না না আমি চাঁদা তুলতে যাবোনা।
- কেন? যাবিনা কেন শুনি?
- চাঁদা তুলতে গেলেই লোকেরা খুব অপমান করে।
- কি যা তা বলছিস। হ্যাঁ, কখনো কখনো বাড়ীর লোকেরা মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে বটে। এই তো কাল, কালো মাসিমার বাড়ী যাচ্ছিলাম। তা মাসি বুঝতে পেরে দোতলা থেকে গরম জল ছিটিয়ে দিলো। পরশু হারানের মশলার দোকানে গেছিলাম। বেটা হাত ঝেড়ে লঙ্কার গুঁড়ো চোখে ছেটাল। কিন্তু কই কেউ কখনো অপমান তো করেনি!
আমি হতবাক, কি বলছো, দেবাশীষ দা, এর পরেও তুমি বলবে, কেউ অপমান করেনি?
- না না তুই ভুল ভুঝেছিস।

লেখক পরিচিতি: 
দীপারুণ ভট্টাচার্য্য, শ্যামাপ্রাসাদ মুখার্জী ইনস্টিটিউট এবং উৎকল উনিভার্সিটির প্রাক্তনী বর্তমানে ফরিদাবাদ নিবাসী। লেখার শুরু ১৪-১৫ বছর বয়সে, কবিতা দিয়ে। তার পর গল্প আর নাটক। আরেক বেদুইন, সংকল্প, জোয়ার ইত্যাদি বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এনার লেখা বেরিয়েছে।

লেখকের নতুন প্রয়াস এই অনুগল্প। এনার ফেসবুক পেজ দেয়া রইলো নিচে। 
https://www.facebook.com/Diparun.Bhattacharyya/





No comments:

Powered by Blogger.