Header Ads

আজকের ছোটো গল্প "স্বাধীনতা" - লিখেছেন মোনালিসা চৌধুরী দাস

আজ 15 ই আগস্ট, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বীরভূম জেলার নারায়ণ পুর গ্রামে দেশপ্রিয় বালিকা বিদ্যালয়ের  প্রাঙ্গণে একটা ছোট্ট অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে ।এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছেন এই স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের বাল্যবন্ধু একদা কোলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি শ্রী অরুনোদয় মুখোপাধ্যায় । স্কুলে তাই আজ সাজসাজ রব।কচিকাচারা সব তৈরি অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণের জন্য ।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি শ্রী অরুনোদয় মুখোপাধ্যায় এর হাতে স্কুলে পতাকা উত্তোলনের পর স্কুলের টিচার ইনচার্জ ওনার সাথে স্কুলের অন্যান্য সব টিচার দের একে একে পরিচয় করিয়ে দিলেন ।সবার শেষে পরিচয় হল বাংলার শিক্ষিকা, ছিপছিপে গড়নের শ্যামবর্ণা, স্কুলের ছাত্রীদের সবচেয়ে প্রিয় দিদিমণি দূর্গারাণী গরাই এর সাথে ।সকলের সঙ্গে পরিচয় পর্বের পর নিজের প্রধান অতিথির চেয়ারে গিয়ে বসলেন অরুনোদয় । বিচারপতি হিসেবে অনেক মামলার রায় উনি দিয়েছেন কিন্তু তারমধ্যে খুব কম সংখ্যক মামলার স্মৃতি তার আজ মনে রয়ে গেছে ।সেরকমই একটা না ভুলতে পারা স্মৃতি তার কাছে এই দূর্গারাণী গরাই । দীর্ঘ কুড়ি টা বছর পর আজও তার মনে আছে  রিটায়ার্ড মেন্টের আগে সেটাই ছিল তার সর্বশেষ রায় কোলকাতা হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে অরুনোদয়ের ।

সবুজ ফাইল বন্দি  কতগুলো সাদা কাগজে লেখা একটা ষোলো বছরের মেয়ের জীবনের গল্প,  তার বাঁচতে চাওয়ার গল্প ,সবার বিপক্ষে গিয়ে নিজের স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের গল্প  ,একজন বিচারক হিসেবে এই সবকিছু ভুলে যাওয়া সম্ভব হলেও একজন মানুষ হিসেবে আর সর্বোপরি একজন পিতা হিসেবে যা ভুলে যাওয়া অসম্ভব ছিল অরুনোদয়ের পক্ষে ।

সারা আকাশ আজ ছেয়ে গেছে কালো মেঘে ।মনে হচ্ছে আকাশের গায়ে কেউ যেন আলকাতরা ঢেলে দিয়েছে ।মা আজ অনেক বার বারন করেছিল দূর্গা কে এতদূর রাস্তা পেরিয়ে টিউশন পড়তে না যেতে কিন্তু সপ্তাহে এই একটা দিন স্কুলের স্যার নিজের বাড়িতে একটু সময় বার করে দূর্গা এবং তারই মতো কিছু অভাবী ছেলে মেয়েদের বিনা পারিশ্রমিকে পড়ান । তাই সপ্তাহের এই একটা দিন শত বাধা এলেও দূর্গা স্কুল থেকে ফিরে এসে নাকে মুখে একটু খাবার গুঁজেই ছোটে
স্যারের বাড়ি । দূর্গা ছেলেবেলা থেকে পড়াশোনাতে খুব মনোযোগী ।তাই অনেক অভাবেও তার মা, সরমা মেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে ।দূর্গা যখন বছর পাঁচের তখন তার বাবা প্রায় বিনা চিকিত্সায়  জন্ডিসে মারা যায় । দূর্গার ভাই ছোট্টু তখন মাত্র একবছরের ।স্বামী মারা যাবার পর অনেক কষ্টে লোকের বাড়ি রান্না করে সরমা মানুষ করছে তার দুটি ছেলে মেয়েকে ।

দূর্গার সামনে এখন তার মাধ্যমিক পরীক্ষা ।গ্রামের স্কুল থেকে এবারের ক্লাস টেনের টেস্ট পরীক্ষায় দূর্গা সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে । তাই স্কুলের সব স্যারদের তাকে নিয়ে অনেক আশা । দূর্গার প্রিয় বিষয় বাংলা ।বড় হয়ে সে বাংলা নিয়ে অনেক পড়াশোনা করে স্কুলের দিদিমণি হতে চায় ।অনেক স্বপ্ন তার দুচোখ জুড়ে । আমার প্রিয় ঋতু বর্ষাকাল রচনা টা নিজে লিখে যেদিন ক্লাস ভর্তি সকলের সামনে দূর্গা পড়ে শুনিয়েছিল তখন বাংলা স্যার দূর্গার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন " আশীর্বাদ করি তুই একদিন অনেক বড় হবি "।বাড়িতে ফিরে মা কে এসব কথা জানিয়েছিল দূর্গা নিজের মেয়ের জন্যে গর্বে সেদিন বুকটা ভরে গিয়েছিল সরমার ।

একফোঁটা দুফোঁটা করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে কিন্তু তাতে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই দূর্গার । "একবার কোনও রকমে স্যারের বাড়ি পৌঁছে গেলেই স্বস্তি" এসব ভেবে নিজের সাইকেলের স্পীড টা আরও একটু বাড়িয়ে দিল সে ।হঠাত্ ভালো করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাস্তায় মধ্যে রাখা একটা বড় পাথরে ধাক্কা লেগে সাইকেল নিয়ে রাস্তার একপাশে ছিটকে পড়ল দূর্গা ।ততোক্ষনে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে ।অত জোরে পড়ে যাওয়াতে বেশ জোরেই লেগেছে তার কোমরে ও
পায়ে । বেশ খানিকটা জায়গায় হাঁটুর কাছে কেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে বুঝতে পারল দূর্গা ।

অন্য দিন সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে টিউশন থেকে দূর্গা ফিরে আসে বাড়ি কিন্তু আজ আটটা বাজল এখনও দূর্গা টিউশন থেকে ফিরলনা ।চিন্তায় সরমা ঘর বার করছে কেবলই ।ছোট্টু নিজের পড়ার বই খুলে বসেছে কিন্তু তারও মন বসছে না পড়াতে ।মনটা পড়ে আছে বাইরের দরজার দিকে ।

দিদির দিয়ে যাওয়া হোমওয়ার্ক এর সব অঙ্ক সে আজ করে রেখেছে ।কাল স্কুলে ছোট্টুর ইতিহাস পরীক্ষা তাই দূর্গা ফিরে এসে সমস্ত প্রশ্ন উত্তর তাকে জিজ্ঞাসা করবে টিউশনে বেরনোর আগে ভাই কে তা  বলে গেছে সে । কিন্তু দিদির তো দেখা নেই সেই ভেবে মুখ বেজার করে বসে থাকে ছোট্টু ।

সরমাদের গ্রামে তেমন কোনও শিক্ষক নেই ।যারা স্কুলে পড়ান তারা সকলেই অন্য গ্রাম থেকে আসেন । তাই বাড়ি থেকে দু কিলোমিটার দূরে পাশের গ্রামে যেতে হয় দূর্গা কে টিউশনের জন্য । মেয়েটা পড়াশোনা তে খুব আগ্রহী তাই ইচ্ছে না থাকলেও সরমা কোনও দিনই দূর্গা কে বারন করেনি এই এতটা রাস্তা সাইকেল চালিয়ে টিউশন পড়তে যাবার ব্যাপারে ।

এদিকে ঘড়ির কাঁটা ন টার দিকে এগোচ্ছে । রাত যত বাড়ছে ততই পাল্লা দিয়ে চিন্তাও বাড়ছে সরমার ।
" এত বৃষ্টিতে নিশ্চয়ই স্যারের বাড়ি আটকে গেছে দূর্গা " নিজের বলা কথাগুলো কেমন যেন সান্ত্বনার মতো শোনাচ্ছে আজ সরমার । বৃষ্টি টা কমেছে, আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে ছোট্টু কে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সরমা কিন্তু কিছু দূর গিয়ে  থানা থেকে ওরই খোঁজে আসা একজনের মুখে সরমা জানতে পারল সন্ধ্যার সময় দূর্গা কে অচৈতন্য বিবস্ত্র অবস্থায় ক্যানেলের ধারে পাওয়া  গেছে ।কথাগুলো শোনার পর উদভ্রান্তের মতো থানার দিকে ছুটতে শুরু করল সরমা।

থানায় গিয়ে সে জানতে পারল ওদের গ্রামেরই এক ধনী পরিবারের বখাটে ছেলে মদ্যপ অবস্থায় তার দূর্গার এই চরম সর্বনাশ করেছে ।  সাইকেল থেকে পড়ে যাওয়ার পর দূর্গা কে জোর করে সে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় ক্যানেলের ধারের ঐ ফাঁকা জমিতে ।হিংস্র পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে দূর্গার  শরীরটার ওপর । দূর্গা নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে প্রানপন চেষ্টা করেছিল  ঐ মানুষরুপী পশুটার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর । কিন্তু সে পেরে ওঠেনি । দূর্গার সেই কান্না, বাঁচার আর্তনাদ কেউ শুনতে পায়নি সেদিন ।

এই ঘটনার পর কেটে গেছে দুটো মাস ।সময়ের সঙ্গে দূর্গার শরীরে আঁচড়ের কামড়ের দাগ মিলিয়ে গেলেও ওর মনে তৈরি হওয়া বিষাক্ত ক্ষতটা মেলানো কখনওই সহজ ছিলনা । সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতির কথা মনে পড়লেই সরমা কে জড়িয়ে ডুকরে কেঁদে উঠত দূর্গা ।ছোট্টু বুঝতে পারতনা তার দিদির ঠিক কি হয়েছে?কেন তার দিদি আর তাকে অঙ্ক বুঝিয়ে দেয়না ,পড়া জিজ্ঞাসা করেনা ।

হঠাত্ করে জীবনটা সেদিনের পর যেন একবারে  স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল তাদের সবার।  এই দু মাসে অনেকবার দূর্গাদের থানায় ও কোর্টে যেতে হয়েছে । ধর্ষণে অভিযুক্ত ধনী পরিবারের ছেলে তাই টাকা দিয়েও কেস তুলে নেওয়ার কম চাপ আসেনি দূর্গারের ওপর কিন্তু কোনও কিছুই দমাতে পারেনি দূর্গা কে। এরই মধ্যে দূর্গার কিছু শারীরিক অসুস্থতার কারণ হিসেবে গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তারবাবু যখন জানায় দূর্গা অন্তঃসত্ত্বা, তখন পা থেকে মাটি সরে গেছিল সরমার ।খবর টা জানাজানি হবার পর ধর্ষণে অভিযুক্ত ছেলেটির মা নিজের একমাত্র ছেলেকে বাঁচানোর জন্য দূর্গাকে তার গর্ভে বেড়ে ওঠা সন্তানের দোহাই দিয়ে তাকে নিজের ছেলের বৌ করবার চেষ্টাও চালিয়েছিল ।

এরপর ক্রমশ তার ওপর হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে দূর্গার এই লড়াই টা আরও কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যায় ।দূর্গার কেস টা জেলা আদালত থেকে চলে আসে কোলকাতা হাইকোর্টে ।

আজও মনে আছে অরূনোদয়ের,আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সেদিন সেই,  মাত্র ষোলো বছরের ধর্ষিত মেয়েটির তাকে করা প্রশ্ন গুলো । ধর্ষণের ফলস্বরূপ তার গর্ভে বেড়ে ওঠা সন্তানকে দৃঢ় কন্ঠে দূর্গা সেদিন  অস্বীকার করেছিল ।কোর্ট সুদ্ধু লোকের সামনে জোর গলায় বলেছিল  যে অন্যায়ের জন্য তার জীবন আজ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে এই সন্তান কে মেনে নেওয়ার অর্থ ওর ওপর হওয়া সেই অন্যায় কে মেনে নেওয়া ।তাই ধর্ষনের ফলে তার গর্ভে বেড়ে ওঠা এই সন্তান কে সে জন্ম দিতে চায়না ।

এরচেয়ে মহামান্য আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দিলে সে তা হাসিমুখে মেনে নেবে । দূর্গার একটাই আর্জি ছিল
নিজের ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতাটুকু যেন সে পায় । নিজের পুরনো যন্ত্রণার স্মৃতি কে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার , এইভাবে রুখে দাঁড়িয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার স্বাধীনতা ,ভালোভাবে বেঁচে থাকবার আরও একটা সুযোগ চেয়েছিল সে আদালতের কাছে সেদিন ।

একজন বিচারক হিসেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া বেশ কঠিন হয়েছিল অরুনোদয়ের কাছে । তবে ধর্ষণের অভিযুক্ত ছেলেটিকে কঠিন শাস্তির সঙ্গে দূর্গাকে তার নিজের ভবিষ্যত জীবনের সমস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা সেদিন দিতে পেরেছিলেন
অরূনোদয় ,দূর্গা কে ।

আজ কুড়ি বছর পর সেই দূর্গা কে দেখে অরূনোদয়ের সত্যিই মনে হচ্ছে সেদিন কোর্টে অনেকে তার রায়ের বিরোধিতা করলেও তিনি যে সঠিক ছিলেন আজ তা প্রমাণিত ।

" স্যার চলুন আপনার গাড়ি রেডি আছে " ড্রাইভারের কথায় কুড়ি বছর আগের ফেলে আসা অতীত থেকে ফিরে এলেন অরুনোদয় ।অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে । তাই উপস্থিত সবাই কে বিদায় জানিয়ে অরূনোদয় নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন । হঠাত্ পিছন থেকে একটা ডাকে তিনি পিছন ফিরে দেখলেন দূরে দূর্গা দাঁড়িয়ে ।সে কাছে এসে অরূনোদয়ের পা ছুঁয়ে  জিজ্ঞাসা করল "আমাকে চিনতে পারছেন স্যার" ? দূর্গার ফেলে আসা সেই ভয়ঙ্কর অতীত আজ প্রাক্তন বিচারপতি অরূনোদয়ের কাছে মূল্যহীন তাই নিজের হাত আশীর্বাদ স্বরুপ দূর্গার মাথায় রেখে স্ফীত হেসে অরূনোদয়  বললেন "চিনতে পেরেছি আপনি এই দেশপ্রিয় বালিকা বিদ্যালয়ের বাংলা শিক্ষিকা
দূর্গারাণী গরাই " ।।।।


লেখিকা পরিচিতি - লেখিকার নাম মোনালিসা চৌধুরী দাস। এনার লেখনীই এনার প্রথম পরিচয়। আসানসোলে শহরে বড়ো হয়ে ওঠা আর ঊষাগ্রাম গার্লস হাই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই লেখালেখি তে হাতেখড়ি। লেখিকা হিসেবে প্রথম পরিচিতি "ইচ্ছেডানা" ম্যাগাজিনের হাত ধরে। আসানসোল গার্লস কলেজের এই প্রাক্তনী বর্তমানে স্বামী ও কন্যা সহ কলকাতা শহরের বাসিন্দা।

লেখিকার নিজস্ব ফেসবুক প্রোফাইল থাকলেও গল্পের জন্য আলাদা কোনো পেজ নেই, তাই লিংক দেওয়া গেলো না। তবে আপনারা মতামত জানাতে পারেন নিচে কমেন্ট বক্সে।   



No comments:

Powered by Blogger.