Header Ads

আজকের ছোটো গল্প "সেতু" - লিখেছেন মোনালিসা চৌধুরী দাস

এমন একটা দুঃসংবাদের জন্য  একেবারে প্রস্তুত ছিলনা কাজরী ।ফোনে লাইন টা কেটে যাবার পরও মোবাইল টা কানে চেপে দাঁড়িয়ে রইল নিশ্চল । এইমাত্র ফোনে শোনা কথাগুলোর রেশ কেমন যেন অবশ করে দিচ্ছে তার সমস্ত শরীরকে ।জীবনে সহ্য করতে করতে তার মনটাও অনেক কঠিন হয়ে গেছে এখন ।

অফিসের বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা দিয়ে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল কাজরী ।একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলল" মীডল্যান্ড নার্সিংহোম "। একটু আগে কাজরীর মোবাইল ফোনে, ফোনটা ওখান থেকেই এসেছিল ।

রশ্মির কলেজ যাবার পথে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে ।কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্রী সে ।ছোটবেলা থেকেই ভীষণ জেদি প্রকৃতির রশ্মি।এই জেদ টা তার মায়ের মতোই হয়েছে এমনটাই সবাই বলে ।কাজরী ও প্রবালের একমাত্র সন্তান রশ্মি ।

ট্যাক্সি তে যেতে যেতে ব্যাগ হাতড়ে একটা ছোট্ট কাগজে লেখা প্রবালের মোবাইল নম্বরে একটা মেসেজ লিখল কাজরী ।শেষ কবে প্রবালের সঙ্গে ওর কথা হয়েছিল মনে পড়ে না তার, তবু নম্বর টা রেখে দিয়েছে সে ।একে অপরকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল তারা দুজনে ।কিন্তু রশ্মির যখন দশ বছর বয়স তখন থেকেই মেয়েকে নিয়ে আলাদা থাকে কাজরী ।তাদের ডিভোর্স হয়নি তবুও  তারা বিচ্ছিন্ন, আজ  ন-বছর হলো। প্রবাল কোনও দিনই সে অর্থে সংসারী ছিলনা ।কাজ পাগল মানুষ ছিল সে ।নিজের ব্যবসার কাজে প্রায়ই তাকে বাড়ির বাইরে থাকতে হতো।সেই শুরু ভুল বোঝাবুঝির ।প্রবালের কাছে নিজের কাজের গুরুত্ব তার স্ত্রী ও সন্তানের চেয়ে বেশি এমনটাই ধারণা ছিল কাজরীর ।প্রবালের জীবনে সে গুরুত্বহীন এটা মন থেকে যেদিন পুরোপুরি ভাবে  মেনে নিয়েছিল  কাজরী ,সেদিন এই সম্পর্ক থেকে সরে আসে সে । মেয়ে কে নিয়ে আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নেয় ।সেদিন প্রবালের কোনও কথাই শোনেনি কাজরী ।সেদিন বাবাম ও মা এর এই আলাদা হয়ে যাওয়ায় যে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিল , সে হল রশ্মি । এরপর  অনেক রকম ভাবে সে চেষ্টা করে গেছে  তার বাবাম ও মা কে এক করার ,তার স্বপ্নই ছিল তারা তিনজনে আবার আগের মতো একসঙ্গে থাকবে ।সবটাই জানতো কাজরী । তবুও  সে মা হয়ে কিছুই করতে পারেনি। নিজের ইগো কেই বড়ো করে  দেখেছে সবসময় । বারবার মেয়েটার মুখটা মনে পড়ছে কাজরীর আর বুকের ভীতরটা হু হু করে উঠছে যেন ।

ট্যাক্সি মীডল্যান্ড নার্সিংহোমে যখন পৌঁছলো তখন বেলা একটা ।প্রকান্ড নার্সিংহোম ।বাইরে রশ্মির কলেজের কিছু বন্ধুদের দেখতে পেল কাজরী কিন্তু কোনও কথা না বোলে কাঁচের ভারী দরজা ঠেলে ভীতরে ঢুকে, হেল্পডেস্ক এ জিজ্ঞাসা করে সোজা লিফটে উঠে গেল  চারতলায়। আই সি ইউ তে ।

সাদা চাদরের তলা দিয়ে বেরিয়ে আছে নীল হলুদ তার যা সংযোজিত হয়েছে কার্ডিয়াক মেশিনে ।বেডের একপাশে লাগানো মনিটরে ক্রমাগত ভেসে উঠছে হৃদয় তরঙ্গের অবিরাম ওঠানামা ।আচ্ছন্ন অবস্থায় রয়েছে রশ্মি। ঠোঁট দুটো ঈষৎ ফাঁক ,চোখ দুটো বন্ধ । মাথায় ব্যান্ডেজ । কাজরী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলনা একটা চেয়ারে বসে পড়ল ।মাথাটা কেমন যেন ঘুরে গেল তার রশ্মি কে এই অবস্থায় দেখে ।আজ সত্যিই নিজেকে বড্ড নিঃসঙ্গ ও অসহায় লাগছে তার ।থাকা বলতে শুধুমাত্র একদাদা ও বৌদি ।তারাও এখন শহরের বাইরে ছেলের কাছে ।

রাত প্রায় তিনটে আধঘণ্টা হলো দিল্লি থেকে কলকাতা গামী বিমান কলকাতার মাটি ছুঁয়েছে সবেমাত্র ।এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে প্রবাল দেখল  ন-বছর আগে ছেড়ে চলে যাওয়া তার  প্রিয় শহরকে ।যার হাত ধরে তার প্রেম, বিয়ে ,সন্তান ।জীবনের পঁয়তাল্লিশ টা বছর কাটিয়েছে সে এই শহরে ।কত স্মৃতি  যেন ভীড় করে আসছে তার মনে ক্রমাগত ।

প্রবালের ট্যাক্সি দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে ভি আই পি রোড ধরে। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি।  শহর কলকাতা তখনও ঘুমিয়ে ।প্রবাল " মীডল্যান্ড নার্সিংহোমে" যখন পৌঁছলো তখন সবে ভোর হচ্ছে ।

সারাদিনের ক্লান্তি আর মানসিক চাপে কখন  চোখ লেগে গেছিল কাজরীর। নার্সিংহোমের নীচে ভিসিটারস রুমে ।হঠাত্ কাঁধের ওপর একটা খুব চেনা হাতের স্পর্শে পিছনে ফিরে  সে দেখলো সামনে প্রবাল দাঁড়িয়ে হাতে ধরা ধুমায়িত কফি কাপ । " নিশ্চয়ই কাল থেকে চিন্তায় কিছু খাওয়া হয়নি তোমার। এই কফি টা খাও আর আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি আমাদের 'মামমাম' এখন আউট অফ ডেনজার ।তাই আজই ওকে আই সি ইউ থেকে জেনারেল বেডে সীফট করা হবে "।

কথাগুলো একটানা বলে গেল প্রবাল ।ছোটবেলায় তারা দুজনে  আদর করে 'মামমাম 'নামেই ডাকতো রশ্মি কে ।প্রবালের থেকে আলাদা হবার পর আর কখনও ওই নামে ডাকেনি কাজরী তাকে ।রশ্মি ই একমাত্র সেতু ছিল তাদের দুজনের মধ্যে ।যার মাধ্যমেই বিগত এই ন-বছরে প্রবালের সব খবর সে রেখেছে ।

কাজরী ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিল না যে এই পৃথিবীতে এখনও এমন একজন মানুষ আছে যে তার এক ডাকে সবকিছুকে উপেক্ষা করে ছুটে চলে আসতে পারে এতদূরে তার কাছে । তাই  সব অভিযোগ, অনুযোগ ,রাগ,দুঃখ সমস্ত বাধাকে  দূরে সরিয়ে রেখে  আজও এই মানুষটাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসা যায়,  বিশ্বাস করা যায় ,ভরসা করা যায়।

কাজরী কান্নায় ভেঙে পড়ে জড়িয়ে ধরল প্রবাল কে । তাদের দুজনের এতবছরের জমে থাকা সমস্ত কষ্ট গুলো চোখের জল হয়ে  নেমে এসে ভিজিয়ে দিল  দুজনকে । জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত কাজরী খুঁজে পেল একটুখানি শান্তি প্রবালের বুকের মধ্যে|

এরপর চারদিন পর আজ রশ্মির নার্সিংহোম থেকে ছুটির দিন ।বাবাম ও মা   একসঙ্গে নিতে আসবে তাকে বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য ।তাই আজ আনন্দের শেষ নেই রশ্মির এরকমই  একটা দিনের স্বপ্ন সে দেখেছে বারবার ।
তার বাবাম ও মায়ের বিচ্ছেদের পর অনেক কষ্ট পেয়েছে তার মা ।মায়ের সব হাসির পিছনে লুকিয়ে থাকা কান্নার  সাক্ষী শুধুমাত্র সে নিজে ।তার বাবাম ও অনেক কষ্ট পেয়েছে তাদের থেকে দূরে চলে গিয়ে ।প্রতিবার ফোনে তার বাবামের সেই কান্নায় বুজে আসা গলা চেষ্টা করেও ভুলতে পারেনি কখনও রশ্মি ।অনেক বার নিজের মতো করে চেষ্টা করেছিল রশ্মি তার বাবাম ও মা কে এক করার কিন্তু প্রতি বারই তাদের ইগো তা হতে দেয়নি ।

তাই অবশেষে নিজের প্রানের ঝুঁকি নিয়ে একটা শেষ চেষ্টা করেছিল সে ,তার বাবাম ও মায়ের এই ব্যবধান কে ঘোচানোর ।রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্টের  দিন, ট্রাক টা যখন দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছিল রশ্মির দিকে  তখন রশ্মিও অকুতোভয় এগিয়ে গেছিল সেদিকে ।তার এই ইচ্ছাকৃত  অ্যাক্সিডেন্টের জন্যই  তার বাবাম ও মা আজ আবার সেই  আগের মতো একসাথে।আজ সে আর অন্য কিছু ভাবতে চায়না ।

আজ সে পেরেছে ছোটবেলা থেকে দেখে আসা সেই স্বপ্ন যেখানে তারা তিনজনে একসঙ্গে একই  ছাদের তলায় সেটা বাস্তবায়িত করতে ।  "সেতু "হয়ে মিলিয়ে দিতে দুই প্রান্তে  দাঁড়িয়ে থাকা তার জীবনের  সবচেয়ে প্রিয় দুজন
মানুষকে ।।।।




লেখিকা পরিচিতি - লেখিকার নাম মোনালিসা চৌধুরী দাস। এনার লেখনীই এনার প্রথম পরিচয়। আসানসোলে শহরে বড়ো হয়ে ওঠা আর ঊষাগ্রাম গার্লস হাই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই লেখালেখি তে হাতেখড়ি। লেখিকা হিসেবে প্রথম পরিচিতি "ইচ্ছেডানা" ম্যাগাজিনের হাত ধরে। আসানসোল গার্লস কলেজের এই প্রাক্তনী বর্তমানে স্বামী ও কন্যা সহ কলকাতা শহরের বাসিন্দা।



লেখিকার নিজস্ব ফেসবুক প্রোফাইল থাকলেও গল্পের জন্য আলাদা কোনো পেজ নেই, তাই লিংক দেওয়া গেলো না। তবে আপনারা মতামত জানাতে পারেন নিচে কমেন্ট বক্সে।   



No comments:

Powered by Blogger.