Header Ads

আজকের ছোটো গল্প "দাম্পত্য" - লিখেছেন মোনালিসা চৌধুরী দাস

রান্না ঘর থেকে চায়ের কাপ হাতে বেরিয়ে এল সুচরিতা ।তাদের শোবার ঘর পেরিয়ে ছোট্ট ব্যালকনিতে।টবে রাখা নানারকম ফুলের গাছ দিয়ে তার এই ব্যালকনি সুন্দর করে  নিজে হাতে সাজিয়েছে সে তার মনের মতো করে ।এখানেই মুখোমুখি দুটি চেয়ারে বসে সকালের চা পর্ব সারে সুচরিতা এবং রজত ।তাদের দাম্পত্য জীবনের আজ বত্রিশ বছর অতিক্রান্ত ।

আগে তার শ্বশুরের আমলে ওদের বাড়ির রেওয়াজ ছিল খাঁটি দুধের মধ্যে চা ফুটিয়ে নিয়ে বেশ খানিকটা চিনি সহযোগে তৈরি হতো সকালের চা ।সে সব পাঠ অনেক দিন চুকে গেছে । এখন সকালের চা মানে চিনি ছাড়া এই অখাদ্য গ্রীন টি ।শরীরের জন্যে উপকারী সেইজন্য 
মেয়ের কড়া হুকুম তাই খেতে খারাপ লাগলেও এটাই গলধঃকরণ করতে হয় তাদের ।

সময়ের সঙ্গে জীবনের সবকিছুই আজ পরিবর্তিত ।আগে ছিল বর্ধমানে শ্বশুর, শাশুড়ি, দেওর,ননদ ,ছেলে, মেয়ে সকলকে নিয়ে সুচরিতার ভরা সংসার আর আজ কলকাতা শহরে এই দু  কামরার ফ্ল্যাটে এই দুই বুড়ো বুড়ির বাস ।

মাত্র আঠারো বছর বয়সে সুচরিতার বিয়ে হয় রজতের সঙ্গে ।দুজনের বয়সের ব্যবধান ছিল দশ বছরের ।বনেদি বংশ আর সরকারি চাকুরে পাত্র সহজে হাতছাড়া করতে চাননি সুচরিতার বাবা তাই ঊচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরই মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হন তিনি । একান্নবর্তি পরিবারে বিয়ের পর খুব স্বাভাবিক ভাবেই সংসারের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ে সুচরিতার ওপর ।বিয়ের পর আজ কেটে গেছে বত্রিশটা বছর ।শ্বশুর শাশুড়ি এক এক করে চলে গেলেন ।দুই দেওর বিয়ের পর আলাদা হল তাদের থেকে ।ননদের  বিয়েতে দাদা এবং বড়বৌদি হিসেবে সব দায়িত্ব পালন করেছে রজত ও সুচরিতা কোনও ত্রুটি রাখেনি তারা ।

তারপর ছেলে পারিজাত ও মেয়ে তিন্নি এল তাদের জীবনে ।তারাও যে কখন স্বাবলম্বী হয়ে সংসারী হল সবটাই কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগে আজ সুচরিতার । বিয়ের পর তিন্নি এখন দিল্লিতে থাকে । জামাই অনির্বাণ ও তিন্নি একই অফিসে চাকরি করে দুজন । আর পারিজাত ছেলে ও বৌমা কে নিয়ে এখন আমস্টারডামে ।বছরে একবার করে ছেলে ও মেয়েকে কাছে পায় সুচরিতা ও রজত ।

এইভাবেই চলছিল সুচরিতার জীবন ।কিন্তু এই রুটিন মাফিক জীবনে হঠাত্ করে ঘটল কিছু পরিবর্তন ।যেদিন থেকে ওদের সামনের ফ্ল্যাটে নব বিবাহিত তুলিকা ও অর্ক  এসেছে ও সুচরিতাদের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়েছে, সুচরিতার কেমন যেন ওদের তুলনায় নিজেকে ভীষণ অসুখী মনে হতে লাগল।যে সুচরিতা এতকাল স্বামী সংসার নিয়ে নিজেকে সবসময় খুব সুখী মনে করে এসেছে ।তার সেই ভুল তুলিকা আর অর্ক এসে যেন ভেঙে দিয়েছে ।ওদের দুজনকে একসঙ্গে দেখে তার প্রকৃত অর্থে সুখী দম্পতি মনে হয় ।

খুব মিশুকে স্বভাবের মেয়ে এই তুলিকা এবং ছেলে হিসেবে অর্কর কোনও তুলনা হয়না ।সারাদিন তুলি তুলি করে একেবারে অস্থির অর্ক, সবকিছুই লক্ষ্য করে সুচরিতা ।তুলিরা দুজনেই চাকরি করে । সুচরিতা এবং রজত কে মাসিমা ও মেসোমশাই সম্বোধনে কথা বলে দুজনে ।সুচরিতারাও ভীষণ স্নেহ করে ওদের দুজন কে ।বাড়িতে ভালোমন্দ কিছু রান্না হলে একবাটি সরিয়ে রাখে সুচরিতা ওদের জন্যে ।এই একবছরে বেশ কয়েকবার নেমন্তন্ন করে খাইয়েছে সে  ওদের ।বেশ লাগে ওদের দুজনকে সুচরিতার কত প্রেম দুজনের মধ্যে যা দেখলেই বোঝা যায় ।গত সপ্তাহে আবার তুলিকার জন্মদিনে একটা হিরের আংটি উপহার দিয়েছে অর্ক ওকে ।এই যুগের ছেলে মেয়েরা সত্যি অনেক স্মার্ট ।তা না হলে অর্কর দেওয়া উপহার টা পেয়ে ঘর ভর্তি নিমন্ত্রিতদের সামনে অর্কর গালে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে আই লাভ ইউ বলতে পারে কেউ? অর্ক ও তখন তুলিকা কে জড়িয়ে ধরে বলে উঠেছিল আই লাভ ইউ টু ডিয়ার ।

সেদিনের পর রজতের ওপর মনে মনে বড্ড অভিমান হয় সুচরিতার ।এত বছরের বিবাহিত জীবনে আই লাভ ইউ বলা তো দূরস্থান 
কখনও এরকম আকুল হয়ে নিজের ভালোবাসা প্রকাশও করেনি তার প্রতি । বিয়ের পর থেকে সে তো ঠিক ভাবেই নিজের স্ত্রী ধর্ম পালন করেছে কোনও খামতি রাখেনি ।বিয়ের পর থেকে কতটুকুই বা সময় একান্তে কাটিয়েছে সে রজতের সাথে বেশিরভাগ সময়টাই যে তার কেটেছে হেঁসেলে ।

সুচরিতার আজও মনে আছে তার বড় দেওরের বিয়েতে নীল বেনারসি, খোঁপায় জুঁই ফুলের মালা দিয়ে সেজেছিল সে ।সবাই অনেক প্রশংসা করেছিল সেদিন তার রুপের একমাত্র রজত কিচ্ছুটি বলেনি সেদিন । তারপর সে যখন প্রথমবার রজত কে জানায় যে সে মা হতে চলেছে সুচরিতা ভেবেছিল আনন্দে হয়তো রজত তাকে কোলেই তুলে নেবে কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছুই ঘটেনি ।তোতাপাখির মতো একগাদা জ্ঞানের কথা আওড়েছিল রজত সেদিন এই করবেনা ওই করবেনা ইত্যাদি ইত্যাদি ।

লেখাপড়া বেশি দূর করতে পারেনি সুচরিতা কিন্তু কবিতা লেখার বড্ড সখ ছিল তার।অবসরে দোতলার জানলায় বসে কোন স্বপ্নের জগতে পাড়ি দিত তার মন যা শব্দ হয়ে ঝরে পড়ত সাদা পাতায় ।খুব কম করে হলেও খান কুড়ি কবিতা সে লিখেছিল তখন । কিন্তু সাংসারিক নানা ঝামেলায় কবিতা লেখা এরপর আর সেভাবে কোনও দিন হয়ে ওঠেনি ।শুধুমাত্র নিজে ছাড়া সেই কবিতা গুলো আর অন্য কেউ পড়েনি কোনও দিন ।সময় কোথায় ছিল রজতের কাছে তার লেখা কবিতা পড়বার জন্যে ।

তিন্নির আঠারো বছরের জন্মদিনে কত যত্ন করে রেঁধে ছিল সুচরিতা রজতের ফেভারিট মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘন্ট ।সেদিন তিন্নির সব বন্ধুরা কত সুখ্যাতি করেছিল তার রান্নার একমাত্র রজতের মুখ দিয়ে একটা শব্দও বেরোয় নি  তার রান্নার প্রশংসায় ।সেদিনের পর অভিমানে দুদিন ভালো করে কথা বলেনি সুচরিতা রজতের সাথে তবুও কিছুই বোঝেনি ঐ অবুঝ মানুষ টা ।

চা খেতে খেতে অতীতের এইসব অনেক কথা ভীড় করে আসছে আজ সুচরিতার মনে।কাজের মেয়ে মালতির ডাকে যখন সম্বিত্ ফিরল সুচরিতার সে তাকিয়ে দেখে রজত তখনও খবরের কাগজে মুখ গুঁজে চেয়ারে বসে । রজত আবার বরাবরই খুব শান্ত আর কম কথার মানুষ ।সারাটা জীবন নিজের কাজ, সংসারের দায়িত্ব, ছেলে মেয়ের পড়াশোনা এই নিয়ে কেটে গেছে তার ।তাই নিজের জন্য ভাববার বিশেষ সুযোগ হয়নি কোনও দিন ।বর্ধমান থেকে কলকাতা ট্রেনে ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করে কেটেছে তার জীবনের অনেকটা সময় ।ছেলে মেয়ের পড়াশোনার সুবিধার জন্য বর্ধমানের ঐ পৈত্রিক ভিটে ছেড়ে কলকাতার এই ফ্ল্যাটে উঠে আসা তাদের ।

আজ দুদিন হল শরীর টা একেবারে ভাল যাচ্ছে না সুচরিতার ।এত বছরের অনিয়ম আজ তার শোধ নিচ্ছে শরীর । সন্ধ্যায় কোনও রকমে ডাক্তার দেখিয়ে এসে প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল সুচরিতা ।ঘরের কাজ তো দূরস্থান বিছানায় উঠে বসারও ক্ষমতা নেই তার । হাই ব্লাড প্রেসার, আর্থারাইটিসের ব্যথাটাও বেড়েছে সাংঘাতিক ।রাতের খাওয়া সেরে ডাক্তারের দেওয়া হালকা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

সকালে রজতের ডাকে যখন  ঘুম ভাঙল তখন রজতের হাতে ধরা ওর জন্য তৈরি করা ধুমায়িত চায়ের কাপ । তবে আশ্চর্যের এখন অনেকটাই বাকি ছিল ।কিছুটা মেয়ে তিন্নির কাছে ফোনে আর বাকিটা রান্নার বই পড়ে সাতদিন রান্নাঘরের সমস্ত দায়িত্ব রজত একা হাতে সামলেছে ।তার আনাড়ি হাতের রান্নায় নুন কম,তেল বেশি হলেও দিব্বি তৃপ্তি করে খেয়েছে সব সুচরিতা । তার সঙ্গে ঘড়ি ধরে সুচরিতার খাবার ওষুধ সবকিছু সময় মতো দিয়েছে ।বলা যেতে পারে রীতিমতো নার্সিং করেছে সে ।সুচরিতা শুধু দুচোখ ভরে দেখেছে তার রজতের তাকে নিয়ে এই পাগলামি ।

এ যেন অন্য রজত কে দেখল সুচরিতা এই কয়েকদিনে ।যা তার বত্রিশ বছরের দাম্পত্য জীবনেও সে খুঁজে পায়নি ।
এই সাতদিন অসুস্থতার মাঝে একদিন অর্ক এসে জানিয়ে গেছে যে সে এবং তুলিকা সেপারেশন এ যাচ্ছে । তাদের পক্ষে আর এক ছাদের নীচে থাকা সম্ভব হচ্ছে না ।তাদের সেপারেশন এর পর তুলিকা নিজের অফিসের বস কে বিয়ে করছে  খুব শীঘ্রই।আর তাই অর্কও  পুরনো সব কথা ভুলে গিয়ে নতুন করে নিজের জীবনটা আবার শুরু করতে চায় ।ফ্ল্যাটটা সে তাই বিক্রি করে দিচ্ছে সেটাও জানিয়ে যায় ।দিন কয়েক আগে অর্ক আর তুলিকার ঝগড়ার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল সুচরিতা কিন্তু একটা সম্পর্ক যে এত সহজে শেষ হয়ে যেতে পারে মাত্র একবছরের মধ্যে সে ধারণা তাদের ছিলনা ।স্বামী স্ত্রীর এই সম্পর্ক কি করে এত ঠুনকো হতে পারে নিজেকেই প্রশ্ন করে সুচরিতা ।

সুচরিতা এখন কিছুটা সুস্থ ।এই কদিনে রজত নিজের মতো করে ঘরদোর গুছিয়ে রাখলেও সুচরিতার চোখ গেল বসার ঘরের বইয়ের আলমারিতে বই গুলোর ওপরে পড়া ধুলোর ওপরে ।সেখান টা পরিষ্কার করতে গিয়ে তার হঠাৎ চোখ আটকাল একটা ফাইলের ওপর,  যেখানে খুব যত্ন করে রাখা আছে বত্রিশ বছর আগের তার সেই খান কুড়ি কবিতা লেখা পাতা গুলো ।

বুকের ভীতরটা হু হু করে উঠল সুচরিতার ।এত বছরের জমে থাকা ছোট ছোট অভিমান গুলো চোখের জল হয়ে গড়িয়ে পড়ল তার দু গাল বেয়ে । পায়ের শব্দে সুচরিতা খেয়াল করে রজত কখন এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে ।" কেন কিছু বলোনি এতবছর? "শুধু এটুকু বলেই রজতের বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল সুচরিতা । কারণ এটাই যে  তার একমাত্র নিরাপদ ,ভরসা এবং ভালোবাসার ঠিকানা ।নাই বা পারল এই মানুষটা তার রুপের ,রান্নার এবং তার লেখার প্রশংসা করতে ,জন্মদিনে হিরের আংটি উপহার দিতে , তবুও এই আটপৌরে খাঁটি মানুষটার বুক ভর্তি তার প্রতি অকৃত্রিম যে ভালোবাসা তা সে উপলব্ধি করেছে বার বার ।

প্রকৃত ভালোবাসা তো এটাই যা কোনও কিছু বলার অপেক্ষা রাখেনা ।যেখানে একে অপরকে আই লাভ ইউ বলার প্রয়োজন হয়না । যে কোনও রকম কঠিন সময় যার কাঁধে নিজের মাথা রেখে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় ।এটা বিশ্বাস করা যায় জীবনে যাই পরিস্থিতি আসুক ঐ একটা মানুষ আমার সাথে ছিল আছে এবং চিরদিন থাকবে ।

আর এই একে অপরের প্রতি  বিশ্বাস ও ভালোবাসাটাই হল সুখী দাম্পত্যের ভিত ।।।।

লেখিকা পরিচিতি - লেখিকার নাম মোনালিসা চৌধুরী দাস। এনার লেখনীই এনার প্রথম পরিচয়। আসানসোলে শহরে বড়ো হয়ে ওঠা আর ঊষাগ্রাম গার্লস হাই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই লেখালেখি তে হাতেখড়ি। লেখিকা হিসেবে প্রথম পরিচিতি "ইচ্ছেডানা" ম্যাগাজিনের হাত ধরে। আসানসোল গার্লস কলেজের এই প্রাক্তনী বর্তমানে স্বামী ও কন্যা সহ কলকাতা শহরের বাসিন্দা।

লেখিকার নিজস্ব ফেসবুক প্রোফাইল থাকলেও গল্পের জন্য আলাদা কোনো পেজ নেই, তাই লিংক দেওয়া গেলো না। তবে আপনারা মতামত জানাতে পারেন নিচে কমেন্ট বক্সে।          



No comments:

Powered by Blogger.