Header Ads

আজকের ছোটো গল্প "ভালোবাসা" - লিখেছেন মোনালিসা চৌধুরী দাস

মোবাইল টা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল বিয়াস ।পাশে স্বামী আবীর ঘুমোচ্ছে অকাতরে ।কাল একটা খুব ইমপরট্যান্ট মিটিং আছে তাই জোর করে ঘুমানোর চেষ্টা করল বিয়াস নিজে কিন্তু একটু আগে ফেসবুকে নীল বেনারসি তে কনের সাজে সে ঠিক চিনতে পেরেছে অঙ্কিতা কে ।আগের মতোই সুন্দরী আছে সে এখনও কিন্তু অঙ্কিতার পাশে রৌদ্রক কোথায় ?তবে কি রৌদ্রকের সঙ্গে অঙ্কিতার বিয়ে হয়নি? কিন্তু বিয়াস যতদূর জানে গ্র্যাজুয়েশনের আগে বাড়িতে কিছু না জানিয়ে ওরা কোর্টে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করেছিল ।সেটাও প্রায় বছর আট আগের কথা।

সবাই বলে জীবনে  প্রথম ভালোবাসা কোনও দিন ভুলতে পারা  যায়না ।সেটা মনে প্রানে ভীষণ ভাবে বিশ্বাস করে বিয়াস ।একবছর হল সে বিবাহিত ।স্বামী আবীর তাকে যথেষ্ট ভালোবাসে এবং সে ও  তো কিছু কম ভালোবাসে না আবীর কে।কিন্তু মনের কোথাও কোনও ছোট্ট এক কোণায় আজও রৌদ্রকের স্মৃতি কে সে বাঁচিয়ে রেখেছে । নিজের প্রথম ভালোবাসা কে না পাওয়ার সেই কষ্ট আজও লুকিয়ে আছে তার বুকের  মধ্যে ক্ষত হয়ে ।যে কষ্টটা কাউকে বলার নয় শুধুমাত্র নিজের মধ্যেই রাখার। এসব ভাবতে ভাবতেই  খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়ায় বিয়াস ।স্মৃতির কুয়াশার চাদর সরিয়ে মনে পড়ে যায় তার অতীতের কথা ।

রৌদ্রকের সঙ্গে প্রথম পরিচয় তার স্কুলে ।প্রথম পরিচয়ের সেই দিন, তারিখ সব আজও মনে আছে বিয়াসের । সেই স্কুল থেকেই খুব ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে দুজনের মধ্যে ।এই বন্ধুত্বই ক্রমশ ভালোবাসায় পরিণত হয় বিয়াসের মনে।নিজের চেয়েও একদিন বেশি ভালোবেসেছিল বিয়াস রৌদ্রক কে। সেখানে ছিলনা কোনও লাভক্ষতি  আর চাওয়া পাওয়ার হিসেব,  ছিল শুধু বিয়াসের একতরফা নিঃস্বার্থ ভালোবাসা রৌদ্রকের প্রতি ।  কিন্তু রৌদ্রকের কাছে বিয়াস ছিল শুধুমাত্র একজন খুব ভালো বন্ধু এরচেয়ে বেশি কিছু  না ।

স্কুলের পর রৌদ্রক ভর্তি হয় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সেখানেই ওর  প্রথম আলাপ অঙ্কিতার সঙ্গে । সুন্দরী , স্মার্ট, আধুনিকা সে বিয়াসের চেয়ে সবদিক থেকে কয়েকশো গুন এগিয়ে ছিল ।রৌদ্রকের কাছে অঙ্কিতার ছবি দেখে এমনটাই মনে হয়েছিল বিয়াসের । রৌদ্রক ও অঙ্কিতা যেন ছিল একেবারে পারফেক্ট  ম্যাচ ।

মাঝে মধ্যে রৌদ্রক আসত বিয়াসের বাড়িতে তখন সবসময়ই  রৌদ্রকের মুখে লেগে থাকত অঙ্কিতার কথা। অঙ্কিতা এই বলে ,ঐ বলে ইত্যাদি ইত্যাদি ।বিয়াসও একমনে রৌদ্রকের সেই সব গল্প শুনত ।খুব ভালো লাগত তার রৌদ্রক কে এত খুশি দেখে ।রৌদ্রক যে অঙ্কিতা কে কতখানি ভালোবাসত সেটা ওর বলা প্রতিটা কথা থেকেই বুঝতে পারত বিয়াস ।
কোনও দিনই তাই নিজের ভালোবাসার কথা সে বলতেই পারেনি রৌদ্রক কে ।বড্ড অভিমান হত বিয়াসের রৌদ্রকের প্রতি, একবারের জন্যেও বুঝলনা রৌদ্রক ,যে সে  তাকে কতখানি ভালোবাসে ।এরপর নিজের দাম না পাওয়া অভিমান নিয়ে একটু একটু করে দূরত্ব বাড়িয়ে নিয়েছিল সে রৌদ্রকের থেকে ।তবে বিয়াস সবসময়ই চেয়ে এসেছে রৌদ্রক ও অঙ্কিতা যেন খুব সুখী হয় ।

আজ এতবছর বাদে এসব কি ভাবছে সে?কেন মনে পড়ছে আজ রৌদ্রকের কথা? নিজেকেই প্রশ্ন করল বিয়াস ।আবীরের সঙ্গে সুন্দর সাজানো ভবিষ্যত তার তবুও সে আজ কেন আবার ফিরে যাচ্ছে তার সেই যন্ত্রণার অতীতে সে নিজেও জানেনা ।হয়তো জীবনের প্রথম ভালোবাসা এমনই হয় হাজার  দুঃখ কষ্ট বয়ে নিয়ে এলেও তাকে অস্বীকার করা যায়না ।নিজেকে  বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করল বিয়াস । কখন রাত শেষ হয়ে পূবদিকের আকাশ টা লাল  হয়ে ভোর হয়ে আসছে খেয়াল করল বিয়াস ।

অফিসের মিটিং যখন শেষ হল তখন বিয়াস ঘড়ি দেখল দুপুর দুটো ।এরমাঝে অনেক বার সে চেষ্টা করেছে রৌদ্রকের ফোনে ফোন করার কিন্তু প্রতি বারই নট রিচেবেল।

আবীরের আজ বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হবে তাই আর দেরি করল না বিয়াস লাঞ্চ সেরে বেরিয়ে পড়ল উত্তর পাড়া রৌদ্রকের বাড়ি ।রৌদ্রকের সঙ্গেই চার পাঁচ বার  আগে গেছিল সে তাদের বাড়ি ।রাস্তাঘাট মোটামুটি তার মনে আছে । পুজোর  সময় নবমীর দিন উত্তরপাড়া বাসস্ট্যান্ডে ছাড়তে  এসেছিল রৌদ্রক তাকে  "সাবধানে  যাবি "  বলার পর সেই এক পা এক পা করে রৌদ্রক চলে  যাচ্ছিল দূরে নিস্ফলক দৃষ্টিতে সেই দিকেই চেয়ে ছিল সেদিন বিয়াস ।লাল সাদা টি শার্ট টা ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছিল  ভিড়ের মধ্যে। সেই শেষ দেখা রৌদ্রকের সাথে তার।সেদিনের পর আর কখনও দেখা করেনি সে রৌদ্রকের সঙ্গে ।নিজেকে আর কষ্ট দিতে চায়নি বিয়াস তাই ভুলে যেতে চেয়েছিলে সে রৌদ্রক কে ।

বাস থেকে নেমে  খানিকটা হেঁটে পৌঁছল বিয়াস রৌদ্রকদের বাড়ি ।সেখানে গিয়ে  যা দেখল ,প্রায় বিছানার সঙ্গে লেগে যাওয়া একটা জীর্ণ শরীর । তোবড়ানো গাল, চোখ দুটো কোটরে ঢোকা , সারামুখ ভর্তি বহুদিনের না কামানো দাড়ি ।রৌদ্রক কে এই অবস্থায় দেখে নিজেকে চেষ্টা  করেও কিছুতেই সামলাতে পারল না বিয়াস ।কাকীমার কাছেই সে জানতে পারল প্রায় দেড়বছর আগে অঙ্কিতা কে নিয়ে গাড়িতে দীঘা থেকে ফেরার পথে রৌদ্রকের গাড়ির চাকা স্কীড করে একটা মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে ।অঙ্কিতার সামান্য চোট লেগেছিল কিন্তু রৌদ্রক প্রানে বাঁচলেও তার বাঁ দিকটা মেরুদণ্ডে চোট লাগার ফলে অসাড় হয়ে গেছে ।রৌদ্রকের বাবার মৃত্যুর পর পাওয়া  টাকা  আর ব্যাঙ্কে জমানো সব টাকা পয়সাও প্রায় শেষের পথে রৌদ্রকের ট্রিটমেন্টের খরচ যোগাতে ।এই ঘটনার ছয় মাস পরেই অঙ্কিতা ডিভোর্স দেয় রৌদ্রক কে ।কারণ অঙ্কিতা তার জীবন সঙ্গী করেছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অধিকারী ইঞ্জিনিয়ার রৌদ্রক কে, যে তার সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটতে পারবে কোনও অথর্ব মানুষ কে নয় যার বিছানায় উঠে বসতে গেলেও অন্য কারও সাপোর্ট এর প্রয়োজন হয় ।

 মানসিক ও শারীরিক  সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙে যাওয়া রৌদ্রকের চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়া জল বিয়াসের মনে এক অদ্ভুত জোর এনে দিয়েছিল সেদিন ।নিজের জমানো টাকা দিয়ে আর কিছুটা লোন নিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় নিউরো সার্জেন এর কাছে দুবছর ট্রিটমেন্টের সমস্ত খরচ যোগাড় করেছিল সে ।  আর সঙ্গে  ফিজিও থেরাপি করার পর রৌদ্রক ধীরে ধীরে  সুস্থ হয়ে ওঠে ।

রৌদ্রকের সেই কাঁপা কাঁপা হাত দুটো ধরে বিয়াস নিজের কাছেই সেদিন একটা  প্রতিজ্ঞা  করেছিল ।যে সে কিছুতেই রৌদ্রক কে এভাবে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে দেবে না , শেষ হয়ে  যেতে দেবেনা ।যেমন করেই হোক  ঠিক ফিরিয়ে আনবে আলোতে ।বিয়াস তার প্রতিজ্ঞা রেখেছে ।

মাঝে পেরিয়ে গেছে চারটি বছর । রৌদ্রক আজ পুরোপুরি সুস্থ।চাকরী সূত্রে সে এখন বিদেশে। মা কে নিয়ে এখন সেখানেই পাকাপাকি ভাবে বাস করে সে।

বিয়াস এখন পুরোপুরি দক্ষতার সঙ্গে নিজের সংসার সামলাচ্ছে ।সারাদিন রৌদ্রক রৌদ্রক করে ছুটে বেড়াচ্ছে তার দুবছরের ছেলের পিছনে। আবীর ও ছেলে রৌদ্রক কে নিয়ে সে ভীষণ সুখী ।আর তার প্রথম ভালোবাসা কে  সে নিজের মতো করে বাঁচিয়ে রেখেছে নিজের একমাত্র সন্তানের নামের মধ্যে  দিয়ে ।।।।


লেখিকা পরিচিতি - লেখিকার নাম মোনালিসা চৌধুরী দাস। এনার লেখনীই এনার প্রথম পরিচয়। আসানসোলে শহরে বড়ো হয়ে ওঠা আর ঊষাগ্রাম গার্লস হাই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই লেখালেখি তে হাতেখড়ি। লেখিকা হিসেবে প্রথম পরিচিতি "ইচ্ছেডানা" ম্যাগাজিনের হাত ধরে। আসানসোল গার্লস কলেজের এই প্রাক্তনী বর্তমানে স্বামী ও কন্যা সহ কলকাতা শহরের বাসিন্দা।

লেখিকার নিজস্ব ফেসবুক প্রোফাইল থাকলেও গল্পের জন্য আলাদা কোনো পেজ নেই, তাই লিংক দেওয়া গেলো না। তবে আপনারা মতামত জানাতে পারেন নিচে কমেন্ট বক্সে।    



No comments:

Powered by Blogger.