Header Ads

আজকের ছোটো গল্প "অ্যালবাম" - লিখেছেন মোনালিসা চৌধুরী দাস

কলকাতার বিশিষ্ট নিউরো সার্জেন ডঃ শর্বরী সেন।নিজের হসপিটাল, চেম্বার, কনফারেন্স এসব নিয়ে তুমুল ব্যস্ত।তার সারাদিন এত ব্যস্ততার মধ্যে কাটে যে কখন দিন শুরু হয় আর কখন শেষ হয় মাঝে মধ্যে তাও খেয়াল থাকেনা ডাক্তার শর্বরী সেনের।বাবা মারা গেছেন আজ তিন বছর হল।এখন মা কে নিয়ে সল্টলেকে সুসজ্জিত একটি ফ্ল্যাটে থাকে সে।শর্বরী বরাবরই খুব শৌখিন প্রকৃতির তাই খুব সুন্দর করে নিজের মনের মতো করে তার ফ্ল্যাট টি  সাজিয়েছে সে।সপ্তাহে শুধু রবিবার টা তার ছুটি।সারাদিন বাড়িতেই থাকে সে।মায়ের সঙ্গে গল্প করে, কখনও বই পড়ে, টিভি দেখে ,ঘরের টুকটাক কাজ করে ,বেশ ছুটির আমেজেই কাটায় দিনটা।

আজ সেরকমই এক রবিবার শর্বরীর ছুটির দিন। কাজের মেয়েটা সকাল থেকেই লেগে পড়েছে ঘরের জিনিসপত্র গোছগাছ ও ঝাড়পোঁছ করতে।বিকেলের দিকে কৌস্তভ আসছে ওর মা বাবার সঙ্গে।শর্বরীর় সাথে বিয়ের কথা ফাইনাল করতে।কৌস্তভ নিজেও  একজন ডাক্তার।অনেক দিনের পরিচয় দুজনের। বিয়ের  ব্যাপার তাই মা আজ খুব খুশি।
এরই মধ্যে ,হঠাৎ কিছুু পুরনো জিনিসপত্রের মধ্যে একটা নীল রঙের অ্যালবাম দেখতে পেল শর্বরী।অ্যালবাম টা তার ষোলো বছরের জন্মদিনে বাবার দেওয়া উপহার।অ্যালবামটা হাতে নিয়ে পাতা  ওল্টাতে ওল্টাতে হঠাৎ একটা গ্রুপ ছবিতে তার দৃষ্টি আটকে গেল।

ক্লাস 12 এ সব বন্ধুরা মিলে তোলা।পায়েল,আঁখি, সৌরভ, রাজীব সবাই আছে ছবিতে আর একপাশে দাঁড়িয়ে রোগা,লম্বা অরিন্দম।এখন আর কারোর সাথে সেরকম যোগাযোগ নেই শর্বরীর।বাবা কৃষ্ণনগর থেকে ট্রান্সফার হয়ে  কলকাতা চলে আসার পর আর কোনও যোগাযোগ রাখেনি শর্বরী পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে।সেই পুরনো ঘটনা মনে পড়লে আজও শর্বরীর খুব কষ্ট হয়,কান্না পায়।সব বন্ধুদের কাছে একটা হাস্যকর বস্তু হয়ে গেছিল সেদিন সে।

ছোট থেকেই কো-এড স্কুলে পড়াশোনা শর্বরীর।পড়াশোনা তে বরাবরই সে খুব ভালো ছিল।গায়ের রঙ কালো ছিল তাই বাবা  মা নাম রেখেছিল শর্বরী।সব বন্ধুদের মধ্যে অরিন্দমই ছিল তার বেস্ট ফ্রেন্ড।একসঙ্গে পড়াশোনা, গল্প, আড্ডা, বাড়িতে না বোলে সিনেমা দেখা, টিফিন ভাগ করে খাওয়া এমনকী সিগারেটের প্রথম সুখটানের অভিজ্ঞতাটাও এই অরিন্দমের সঙ্গেই।ক্লাস 10 এ অরিন্দম যখন খুব অসুস্থ হলো তখন শর্বরী রাত জেগে ওর জন্য সমস্ত নোটস বানিয়েছে।অরিন্দমদের আর্থিক অবস্থা তেমন একটা ভালো ছিলনা।কতবার বাড়িতে মিথ্যে কথা বোলে শর্বরী তার বাবার কাছে টাকা নিয়ে অরিন্দম কে সাহায্য করেছে।অরিন্দম তার কাছে বন্ধুর থেকে হয়তো আরও বেশি কিছু ছিল।খুব ভালোবাসত শর্বরী অরিন্দম কে ,নিজের থেকেও বেশি।কিন্তু কখনও নিজের মনের কথা সে অরিন্দমের কাছে প্রকাশ করতে পারেনি।

তারপর  ক্লাস 12 এর পরীক্ষার পর  নিজের মনে অনেক শক্তি সঞ্চয় করে শর্বরী নিজের ভালোবাসার, ভালোলাগার কথা  অরিন্দম কে জানায়।সব জেনে অরিন্দম যে তাকে এত খারাপ ভাষায় অপমান করতে পারে তা শর্বরী কল্পনাও করেনি ।সে নাকি কালো,কুৎসিত তাই কোনও ভাবেই সে তার যোগ্য নয়।এটাই বুঝিয়ে দিয়েছিল অরিন্দম তাকে সব বন্ধুদের সামনে।খুব অচেনা লেগেছিল সেদিন অরিন্দম কে শর্বরীর।অরিন্দম কে কোনও উত্তর না দিয়েই ফিরে এসেছিল বাড়ি সে।কারণ তার চোখের জলের মূল্য, তার ভালোবাসার মূল্য অরিন্দম যে দেবেনা সেটা সেদিন উপলব্ধি করেছিল শর্বরী।এরপর আর কোনও দিন অরিন্দমের মুখোমুখি হয়নি সে ।অনেকটা সময় লেগেছিল নিজেকে সামলাতে। শর্বরীর বাবা সবটাই জানতেন। তাই তার বাবা অফিসে নিজের কলকাতায়  ট্রান্সফার টা প্রায় জোর করেই করিয়েছিলেন।পুরনো কথা মনে পড়লেই আজও শর্বরীর বুকের ভীতরের কষ্টটা গলার কাছে কেমন যেন দলা পাকিয়ে যায়।

চা  টা ঠাণ্ডা জল হয়ে গেছে ।কাজের মেয়েটা কখন চা রেখে গেছে খেয়ালই করেনি শর্বরী।মা ও এদিকে তাড়া দিচ্ছে দুপুরে খেয়ে নেবার জন্য।অন্যমনস্ক ভাবে মোবাইল ফোনটা হাতে নেয় শর্বরী।হসপিটাল থেকে দশটা মিসড কল হেড নার্স অপর্ণার। রবিবার হসপিটাল থেকে খুব এমার্জেন্সি না হলে তাকে কেউ ডিসটার্ব করেনা সচরাচর।শর্বরী ফোন করে অপর্না কে।অপর্না জানায় একটা বছর পাঁচেকের বাচ্চা ছেলে তার মামাবাড়ির ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে পড়ে গেছে। মারাত্মক চোট লেগেছে মাথায় ও শিরদাঁড়ায়।আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে শর্বরী তখুনি বেরিয়ে যায়। হসপিটালে পৌঁছে সোজা ঢুকে পড়ে  অপারেশন থিয়েটারে।একটা ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা শুয়ে আছে অপারেশন টেবিলে ।কি নিশ্পাপ মুখ খানা।শর্বরী স্ক্যান রিপোর্টে একবার চোখ বুলিয়ে শুরু করে অপারেশন ।হসপিটালেরই আরও দুজন জুনিয়র ডাক্তার শর্বরী কে অ্যাসিস্ট করে ।অপারেশন যখন শেষ হয় তখন ঘড়িতে রাত এগারোটা।অপারেশন সাকসেসফুল।জুনিয়র ডাক্তারদের সব বুঝিয়ে শর্বরী যায় রেস্ট রুমে।সারাদিন কিছুই প্রায় খাওয়া হয়নি শর্বরীর খুব ক্লান্ত লাগছে তাই। এক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিল শর্বরী।কৌস্তভ কে এর মাঝে সবকিছু  ফোনে জানিয়েছে শর্বরী।কৌস্তভ নিজেও ডাক্তার তাই সে খুব ভালো বোঝে শর্বরী কে।

হঠাৎ একটা খুব চেনা গলা,  কেউ যেন শর্বরী বলে ডাকল।শর্বরী চোখ খুলে দেখে তার সামনে অরিন্দম দাঁড়িয়ে।এতগুলো বছর পর  আবার দুজনে মুখোমুখি।বিশ্বাস করতে পারছিল না শর্বরী ।  খুব বিধ্বস্ত, চুল উসকো খুসকো ,বোঝা যাচ্ছে সাংঘাতিক মানসিক চাপের মধ্যে সে।অরিন্দম চোখের  জল মুছে নিজেকে  একটু সামলে নিয়ে  জানাল ,এতক্ষণ যে বাচ্চাটির অপারেশন করে শর্বরী যাকে নতুন জীবন দিয়েছে সে অরিন্দমের একমাত্র সন্তান ।কলকাতায় মামাবাড়িতে বেড়াতে এসে এই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। শর্বরী নির্বাক ।

অরিন্দমের চোখের জলে যেন ধুয়ে মুছে যাচ্ছিল শর্বরীর মনে জমে থাকা এত বছরের রাগ,অভিমান, গ্লানি সব।খুব পরিপূর্ণ মনে হচ্ছিল শর্বরীর আজ নিজেকে।অরিন্দম কে তার একমাত্র সন্তান ফিরিয়ে দিয়ে ,সে প্রমাণ করতে পেরেছে যে সৌন্দর্য আপেক্ষিক ।

এই সময়   নার্স এসে  খবর দেয় আই সি ইউ তে একজন নতুন পেশেন্ট ভর্তি হয়েছে খুব সিরিয়াস।কথা শেষ না করে মাঝপথেই শর্বরী ছুটে যায় আই সি ইউ এর দিকে।কারণ আজ তার পরিচয় সে শুধু একজন ডাক্তার আর মানুষের জীবন বাঁচানোই তার জীবনের একমাত্র ব্রত।।।।


লেখিকা পরিচিতি - লেখিকার নাম মোনালিসা চৌধুরী দাস। এনার লেখনীই এনার প্রথম পরিচয়। আসানসোলে শহরে বড়ো হয়ে ওঠা আর ঊষাগ্রাম গার্লস হাই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই লেখালেখি তে হাতেখড়ি। লেখিকা হিসেবে প্রথম পরিচিতি "ইচ্ছেডানা" ম্যাগাজিনের হাত ধরে। আসানসোল গার্লস কলেজের এই প্রাক্তনী বর্তমানে স্বামী ও কন্যা সহ কলকাতা শহরের বাসিন্দা।


লেখিকার নিজস্ব ফেসবুক প্রোফাইল থাকলেও গল্পের জন্য আলাদা কোনো পেজ নেই, তাই লিংক দেওয়া গেলো না। তবে আপনারা মতামত জানাতে পারেন নিচে কমেন্ট বক্সে।   


1 comment:

  1. Darun bhalo laglo golpo ta. Poetic justice at its best. Keep writing. All the best for future endeavours.

    ReplyDelete

Powered by Blogger.